গল্প- ভেড়া চোর

ভেড়া চোর
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

সালটা উনিশশো সাতান্ন আটান্ন হবে। আজ থেকে মোটামুটি বাষট্টি বছর আগে। অমিতের বয়স তখন আঠেরো বছর। অমিতকে মনে আছে তো? আরে আমাদের গ্রামের সেই অমিত, যে, তার বন্ধু মধুচরণের বিয়েতে বরযাত্রী গিয়ে পুরুত বিভ্রাট ঘটিয়েছিল। সময়টা শীতকাল। সে বছর শীতটা পড়ে ছিল জাঁকিয়ে। গ্রামের দিকে শহরের থেকে গরম যেমন কম হয়, শীতটা হয় তেমনি প্রকট। তো সেইরকম এক শীতের সন্ধেবেলা অমিতরা বসে আছে আমাদের গ্রামের দুর্গাদালানে (যেটা আজও আছে)। উদ্দেশ্য আড্ডামারা, তাসখেলা। অবশ্য জায়গাটার একটা নতুন নামকরণ হয়েছে, ‘ভবতারিনী আলু আশ্রম’। নামটা আজগুবি, তবে এ নাম যে কেন হয়েছিল সে খবর অন্তত আমি জানিনা। যাই হোক, ‘ভবতারিণী আলু আশ্রম’এর সদস্য কিন্তু অনেক। অমিত, গোপাল, টিলু, ছঙ্কু, উদ্দিন, বরকত, শম্ভু, সাধু, মধূ, কেতো, আরও অনেকে। বেশিরভাগই গ্রামের ভালো পরিবারের ছেলে এবং ততোধিক বিচ্ছু। ‘ভবতারিণী আলু আশ্রম’এর ছেলেদের নামে গ্রামের লোকজন অতিষ্ঠ। কার বাগানের আমটা, কার গাছের নারকেলটা, আগে আশ্রমে পূজো না দিয়ে আসলে, পুরো বাগান সাফ। তবু গ্রামের লোক তাদের সহ্য করতো একটাই কারণে, দিন হোক বা রাত, বর্ষা হোক বা শীত বিপদে পড়ে ‘ভবতারিনী আলু আশ্রম’এর একটা ছেলেকে খবর দিতে পারলেই হলো, পুরো দল হাজির। তো যে কথা বলছিলাম, অমিতরা কেউ আড্ডা মারছে, কেউ তাস খেলছে, আর বরকত প্রত্যেক দিনের মতো তার রেকর্ড প্লেয়ারে তার ফেভারিট গান চালিয়ে দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে। বরকতের ওই এক খ্যাপামি। রোজ বাড়ি থেকে রেকর্ড প্লেয়ারটা বগলদাবা করে নিয়ে আসবে, সঙ্গে একটাই রেকর্ড, ‘সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়’, আর সন্ধ্যে আটটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত একটাই গান বাজবে, ‘মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা’। গান শুনতে শুনতে বরকত ওখানেই ঘুমিয়ে পড়তো। কেউ ডেকে দিলে বাড়ি ফেরা হতো, না হলে সারারাত ওখানেই কেটে যেত। অন্য কোন গান বাজবে না। কেউ কিছু বললেই তুমুল ঝগড়া। সেই ঝগড়ার ভয়ে তাকে কেউ কিছু বলে না, আর এখন ব্যাপারটা বাকিদের কানে সয়ে গেছে। তার মধ্যে অমিত হঠাৎ টিলুকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি ব্যাপার বলতো, উদ্দিন এখনও এলো না’! আর সেটা বলতে বলতেই উদ্দিন এসে দাঁড়ালো তার সাইকেল নিয়ে। অমিত বললো, ‘কিরে উদ্দিন এতো দেরি হলো’। উদ্দিন জবাব দিল, ‘আমার আব্বা আজ আবার আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল’। অমিত বললো, ‘অ’।

আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, উদ্দিনদের বাড়িতে এটা প্রায় দিনেরই ঘটনা ছিল। উদ্দিনের আব্বা ছিলেন ‘মাদারবক্স’, গ্রামে তাঁর বেশ প্রতিপত্তি ছিল, আর সেটা তিনি বাড়িতেও ফলাবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাই কি হয়? দরবারে যিনি রাজা পরিবারের কাছে তিনি প্রজা। কোনদিন হয়তো মাদারবক্স বেলা বারোটার সময় হাতে একটা মুরগি ঝুলিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে উদ্দিনের মাকে বললেন, ‘মালেকা, এটাকে তেল ঝাল দিয়ে রেঁধে ফেল দেখি’। মালেকা জবাব দিল, ‘রাঁধতে হয় নিজে রাঁধো, পরের গতরে এতকিছু হয়না’।

ব্যাস লেগে গেল ঝগড়া। ঝগড়া করতে করতে উদ্দিনের আব্বা বললো, ‘আমি চললাম রেলে মাথা দিতে’। উদ্দিনের মা উত্তর করলো, ‘যাবার আগে ভাতটা খেয়ে যেও, আমি ভাত আগলে বসে থাকতে পারবো না’। উদ্দিনের আব্বা চুপ। কিছুক্ষণ বাদে স্নান করে এসে ভাতের থালা টেনে খেতে বসে পড়লো। সেদিনও কি নিয়ে লেগেছিল উদ্দিনের মা আর আব্বার মধ্যে। উদ্দিনের আব্বা একটা দড়ি হাতে নিয়ে বললো, ‘আমি চললাম গলায় দড়ি দিতে’। তাতে উদ্দিনের মা বলল, ‘ও দড়িটা পচে গেছে। নতুন গরু বাঁধা দড়িটা নিয়ে যাও, আর ঘরের দরজাটা খুলে রেখো, না হলে ভাঙতে হবে’। আর যায় কোথায় লেগে গেল তুমুল ঝগড়া। তো সেই সব থামিয়ে আসতে গিয়ে উদ্দিনের সেদিন দেরি হয়ে গেল। উদ্দিন সাইকেল রেখে অমিতের পাশে বসে ফিসফিস করে বললো, ‘দাদা কালীসাগরের মাঠে ভেড়ার পাল এসেছে’। কালীসাগর হচ্ছে আমাদের গ্রামের একটা পুকুর। তারপরেই চাষের মাঠ। তখন শীতকালে বিশেষ চাষবাস হতো না বলে মেষপালকরা গ্রামের মাঠগুলোতে ভেড়ার পাল নিয়ে চড়াতে আসতো। অমিত বললো, ‘ঠিক আছে কাল যাবো, আর কাউকে বলার দরকার নেই’। পরদিন সকালে অমিত আর উদ্দিন গিয়ে তদন্ত করে এলো। পালে অন্তত দুশো আড়াইশো ভেড়া হবে, আর সঙ্গে লোক দুজন। আজ রাতেই কাজ সারতে হবে। কাজ মানে, ভেড়া চুরি। দুশো আড়াইশো ভেড়া থেকে একটা সরিয়ে নিলে ভেড়ার মালিক বুঝতেই পারবে না, আর সেটা দিয়ে পরের রাতে জমিয়ে পিকনিক হবে। সেই মতো চারজনের দল ঠিক হলো। অমিত, উদ্দিন, টিলু আর ছঙ্কু। ঠিক হলো টিলু, উদ্দিন আর ছঙ্কু ভেড়াওয়ালাদের পাহারা দেবে আর অমিত সেই ফাঁকে ভেড়া চুরি করবে। কথা মতো সেইদিন রাতে চারজনে এসে জড়ো হলো কালীসাগরের পাড়ে। রাত তখন নটা। চারিদিক নিস্তব্ধ। তখনকার গ্রামে, শীতের রাতে নটা মানে মাঝরাত। একে ইলেক্ট্রিসিটি নেই, চারিদিক অন্ধকার তার উপর ঠান্ডা, সন্ধ্যা হতেই গ্রামের রাস্তায় লোক চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যেতো। চারজনে গিয়ে উঁকি দিলো ভেড়াওয়ালাদের তাঁবুতে। তারা তখন কাঠের আঁচে রুটি বানাচ্ছে, আর পাশে বাটিতে কিছু তরকারি ঢাকা দেওয়া আছে। অমিত চললো ভেড়া সরাতে, বাকিরা তাঁবুর বাইরে পাহারায় রইলো। কিন্তু অমিত যেই ভেড়ার পালের মধ্যে ঢুকেছে শুরু হলো আসল সমস্যা। ভেড়াগুলো অচেনা লোক দেখে পরিত্রাহি চিৎকার করতে লাগলো। ভেড়াওয়ালারা রুটিফুটি ফেলে, ‘ডাকু আয়া, ডাকু আয়া’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে লাঠি হাতে বাইরে বেরিয়ে এলো। ব্যাস আর যায় কোথায়, লেগে গেল মারামারি। ছঙ্কু আর উদ্দিন মারপিটে ওস্তাদ। তারা তুমুল বিক্রমে ভেড়াওয়ালা দুটোর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে লাগলো, কিন্তু টিলু কোথায়? উদ্দিন মারপিট করতে করতেই টিলুর উদ্যেশ্যে গালাগালি দিতে লাগলো। আর হঠাৎই সে দেখতে পেল টিলু তাঁবুর মধ্যে বসে গোগ্রাসে ভেড়াওয়ালাদের বানানো রুটি তরকারি খেয়ে চলেছে। দেখে উদ্দিনের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। এমনসময় সে খেয়াল করলো অমিত ঝোপের আড়াল দিয়ে পালাচ্ছে, আর তার কোলে একটা কিছু রয়েছে। উদ্দিন বুঝলো কাজ হয়ে গেছে। সে সঙ্গে সঙ্গে ভেড়াওয়ালাগুলোকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ছঙ্কুর হাত ধরে নিয়ে ছুটলো অমিতের পিছনে। অমিতের গিয়ে গ্রামের কালীমন্দিরের সামনে অপেক্ষা করার কথা, তো তারাও ছুটলো কালীমন্দিরের দিকে। পথেই পেয়ে গেল টিলুকে। তাকে খুব গালাগালি দেওয়াতে সে বললো, ‘কি করবো, তাঁবুতে ঢুকে দেখি ব্যাটারা রুটি মাংস করে রেখেছে, লোভ সামলাতে পারলাম না ভাই। একটু পরেই তারা এসে পৌঁছল কালীমন্দিরের সামনে, আর সেখানে গিয়ে যেটা দেখলো, সেটা দেখে তাদের চক্ষু চড়কগাছ। অমিত দাঁড়িয়ে আছে, আর তার কোলে একটা সুন্দর ছোট্ট সাদা রঙের ভেড়ার বাচ্চা। উদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো, ‘এটা কি রে! বড়ো ভেড়া কই’? অমিত লাজুক মুখে উত্তর দিলো, ‘বড়ো ভেড়া আনিনি। এটাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, আমি এটাকে পুষবো’। তিনজনে রে রে করে উঠলো। বিশেষ করে উদ্দিন আর ছঙ্কু, কেননা লাঠির বাড়ি তারাই খেয়েছে। কিন্তু কি আর করা যাবে? আর তো কিছু করার নেই। অগত্যা তারা গাঁইগুঁই করতে করতে বাড়ি চলে গেলো, আর অমিত বাড়ি চললো ভেড়ার বাচ্চাটাকে নিয়ে। অমিত বাড়ি ফিরে বাচ্চাটাকে একটা ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখলো। তারপর রাতের খাওয়া শেষ করে বাচ্চাটাকে নিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। অমিত আর অমিতের বাবা একই ঘরে পাশাপাশি দুটো খাটে শুতো। অমিত শুয়ে পড়ার একটু বাদেই অমিতের বাবা ঘর ঢুকলেন। অমিত কে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি ব্যাপার তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লি, শরীর টরির খারাপ না কি’? অমিত এটাসেটা বলে এড়িয়ে গেল। একটু বাদে অমিতের বাবাও শুয়ে পড়লেন, আর তার পরেই শুরু হলো আসল ঝামেলা। লেপের ভেতর গরম পেয়ে ভেড়ার বাচ্চাটা ম্যাঅ্যাঅ্যা করে ডেকে উঠলো আর সেই ডাক শুনে অমিতের বাবা ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন। ‘কোথায় ছাগল ডাকছে রে! বাগানে নয়তো? অমিত বললো, ‘হতে পারে’। অমিতের বাবা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘যাঃ যাঃ তোর মায়ের সখের গাছগুলো সব গেল রে’। এই বলে তিনি দরজা খুলে হারিকেন হাতে ছুটলেন বাগানে। অমিতের খুব খারাপ লাগলো, কিন্তু কিছু করার নেই। একটু পরেই অমিতের বাবা আশ্বস্ত হয়ে ফিরে এসে জানালেন যে বাগানে কিছু নেই। তারপর হ্যারিকেনটা কমিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লেন। আর যেই না শোয়া ওমনি ভেড়ার ছানার ‘ম্যাঅ্যাঅ্যা’। এবার অবশ্য আর অমিতের বাবা উঠলেন না। শুয়ে শুয়েই বললেন, ‘মনে হয় পাঁচিলের ওপাশে ডাকছে। আহারে কাদের বাচ্চা, বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছে, সারারাত কাঁদবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন, আর অমিত অনুভব করলো তার বিছানাটা গরম আর ভিজে ভিজে লাগছে। পরেরদিন সকালে অমিতের বাবা চেম্বার করছেন। রুগীরা সব বসে আছে, হঠাৎ একজন লুঙ্গি পড়া লোক এসে হাজির। সে জানালো যে সে একজন ভেড়াওয়ালা, গ্রামের মাঠে ভেড়ার পাল নিয়ে চড়াতে এসেছে। কাল রাতে চারজনে মিলে তাদের পাল থেকে একটা বাচ্চা চুরি করে নিয়ে গেছে। সকালে গ্রামে খুঁজতে আসায় গ্রামের লোকেরা বললো, ডাক্তার বাবুর ছেলেকে গিয়ে ধর তাহলেই পেয়ে যাবে। তাই সে ডাক্তার বাবুর কাছে এসেছে, যদি তিনি বাচ্চাটা ফেরত পেতে সাহায্য করেন। কথাটা শুনেই আগের রাতের ছাগল ডাকার ব্যাপারটা অমিতের বাবার কাছে জলের মতো পরিস্কার হয়ে গেল। তিনি লোকটিকে আশ্বাস দিয়ে ফেরত পাঠিয়েই অমিতকে ডেকে পাঠালেন। অমিত এসে কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়ালে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন যে তিনি সব জানতে পেরেছেন। হয় অমিত এখুনি গিয়ে ভেড়ার বাচ্চাটা ফেরত দিয়ে আসবে না হয় রাতে ওটাকে নিয়ে বাইরে শোবে। অমিত আর কি করে অগত্যা উদ্দিনকে ডেকে নিয়ে সেই বাচ্চা বগলে করে চললো ফেরত দিতে। মাঠে পৌঁছতেই ভেড়াওয়ালারা তাদের দেখতে পেয়ে ছুটে এলো। অমিত জানালো বাচ্চাটাকে তারা গ্রামের মধ্যে ঘুরতে দেখে ফেরত দিতে এসেছে। ভেড়াওয়ালারা খুব খুশি হয়ে তাদের ধন্যবাদ দিতে লাগলো। আর ঠিক তখনই বাচ্চাটা ডেকে উঠলো, ‘ম্যাঅ্যাঅ্যা’, আর সেই ডাক শুনে পালের মধ্যে থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো বাচ্চার মা’টা, আর বাচ্চাটা অমিতের হাত থেকে লাফ মেরে ছুটে মায়ের কাছে গিয়ে দুধ খেতে লাগলো। আর তার মা পরম স্নেহে তাকে চাটতে লাগলো। সেটা দেখে আনন্দ আর অনুশোচনায় অমিতের চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো।

Loading

Leave A Comment